Compilation By – Abdur Rahman
আল্লাহ সোবহানাহু তায়ালা অত্যান্ত দয়া মায়া করে সমগ্য মানব জাতি বিশেষ করে মুত্তাকীদের জন্য আল কোরআন নাযিল করেছেন তাদের হেদায়েত বা পথ প্রদর্শনের জন্য। আল্লাহ ঘোষণা করেন-
هٰذَا بَیَانٌ لِّلنَّاسِ وَ هُدًی وَّ مَوۡعِظَۃٌ لِّلۡمُتَّقِیۡنَ “এটি (আল কোরআন) মানব জাতির জন্য একটি সুস্পষ্ট সতর্কবাণী এবং যারা আল্লাহকে ভয় করে তাদের জন্য পথনির্দেশ ও উপদেশ”- সূরা আল ইমরানঃ ১৩৮।
সূরা বাকারার আল্লাহ বলেন- ذٰلِکَ الۡکِتٰبُ لَا رَیۡبَ ۚ فِیۡهِ ۚ هُدًی لِّلۡمُتَّقِیۡنَ – “এটি আল্লাহর কিতাব যার মধ্যে কোন সন্দেহ নেই, এটি হিদায়াত বা পথ প্রদর্শক মুত্তাকীদের জন্য” -আল বাকারাঃ০২।
এ আয়াতগুলো থেকে অমরা বুঝতে পারি এই পবিত্র মহাগ্রন্থ্য আল কোরআন থেকে তারাই হেদায়েত পাবে যারা মুত্তাকী।তাই, মুত্তাকী আসলে কি? মুত্তাকী কাকে বলে বা কারা, মুত্তাকীদের পরিচয় কি? গুণ বা বৈশিষ্ট্যই বা কি রকম ! তা, জেনে বুঝে, আমাদেরকে কোরআন থেকে হেদায়েত বা পথনির্দেশনা পাওয়ার জন্য অবশ্যই মুত্তাকী হতে হবে।
আজকে আমরা মুত্তাকী শব্দের সঠিক অর্থ ও সংজ্ঞা, মুত্তাকী কারা, আল কোরআনে মুত্তাকীদের যে পরিচয় বর্ণনা করা হয়েছে তা এক এক করে জানবো ইন শা আল্লাহ!
মুত্তাকী শব্দের অর্থ কি?
মুত্তাকী শব্দের অর্থ- আল্লাহ ভীরু,ধার্মিক,পরহেজগার,দ্বীনদার,আল্লাহর অপছন্দনীয় বিষয় থেকে বেঁচে থাকা এবং পাপ থেকে বেঁচে থাকে এমন ব্যক্তি ।
মুত্তাকীর সংজ্ঞা কি বা মুত্তাকী কাকে বলে?
আর মুত্তাকীর সংজ্ঞা হলো- যারা সদা সর্বদা আল্লাহর ভয় মনে পোষণ করে এবং আল্লাহর ভয়েই যারা আল্লাহর সকল আদেশ নিষেধ পরিপূর্ণভাবে পালন কর তারাই মুত্তাকী।
মুত্তাকীর কাকে বলে এ সম্পর্কে বিভিন্ন মনিষীদের বাণীঃ–
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাঃ বলেন- “ যে ব্যক্তি নিজেকে শিরক,কবিরা গুণাহ্ এবং অশ্লীল কথা ও কাজ থেকে বিরত রাখে তাকে মুত্তাকী বলে।”
হযরত হাসান বসরী ( রঃ) ইরশাদ করেন- “মুত্তাকী তারাই যারা হারাম কাজ থেকে নিজেরা বিরত থাকে এবং ফরজ কাজসমূহ অত্যান্ত নিষ্টার সাথে পালন করে থাকে।”
হযরত মু‘য়ায ইবনে জাবাল (রাঃ) মুত্তাকীর পরিচয় দিতে গিয়ে বলেন- “যারা শিরক ও মূর্তিপূজা থেকে দূরে রয়েছে এবং একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করে তারাই মুত্তাকী।”
ফাতহুল কাদির(বিখ্যাত হাদিস ব্যাখ্যাগ্রন্থ)-এ একটি হাদিস আছে এমন, মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাঃ ইরশাদ করেন- “কোন বান্দা ততক্ষণ পর্যন্ত মুত্তাকী হতে পারবে না, যতক্ষণ না সে অসুবিধা নেই, এমন বস্তুকে ছেড়ে দেয় ,এই ভয়ে যে,অসুবিধা আছে এমন কাজে, সে জড়িয়ে যেতে পারে।”
তাহলে অমরা বুঝতে পারলাম যে, মুত্তাকী হলো ঐ ব্যক্তি যে সব সময় আল্লাহকে ভয় করে সকল প্রকার পাপ ও অশ্লীল কাজ হতে বিরত থাকে এবং আল্লাহর সকল হুকুম তথা আদেশ নিষেধ মেনে চলে। যারা কোরআন অনুযায়ী নিজেদের জীবনকে সাঁজিয়ে নেয় এবং পরিচালনা করে মূলতঃ তারাই মুত্তাকী।
আল কোরআনের আলোকে মুত্তাকীদের পরিচয়ঃ-
মুত্তাকী কে বা কারা? মুত্তাকীদের গুণ বা বৈশিষ্ট্য কি? মুত্তাকীদের সম্পর্কে আল কোরআন কি বলছে? আসুন জেনে নেওয়া যাক।
আল কোরআনে বর্ণিত মুত্তাকীদের অত্যাকশ্যকীয় ৫টি গুণ হলোঃ-
১) ঈমানঃ-
আল্লাহ বলেন- الَّذِیۡنَ یُؤۡمِنُوۡنَ بِالۡغَیۡبِ “যারা গায়েবে বিশ্বাস স্থাপন করে অর্থাৎ অদৃশ্যে ঈমান আনে” – আল বাকারাঃ ৩।
মুত্তাকী হওয়ার জন্য সর্ব প্রথম যে গুণ অর্জন করতে হবে তা হলো ঈমান আনা তথা গায়েবে বিশ্বাস স্থাপন । মুত্তাকীদেরকে আল্লাহ, ফেরেস্তা, জান্নাত,জাহান্নাম, আরশ, কুরসি, লওহ, কলম, তাকদির, মিজান, পুনরুথ্থান,
পুলসিরাত, আলমে আরওয়াহ্,আলমে বারঝাখ,আল্লাহর অস্থিত্ব,আত্মার স্বরুপ,পরকাল,শেষ বিচারের দিন ইত্যাদি যা ইন্দ্রিয় জ্ঞান দ্বারা অনুভব করা যায় না। সে সব বিষয়ের প্রতি নিশ্চিতভাবে বিশ্বাস করতে হয় ও মেনে নিতে হয় এবং সেই আলোকে তাদের জীবনকে সাঁজাতে হয়,পরিচালনা করতে হয়।
২) আমলঃ–
এ ব্যাপারে আল্লাহ বলেন- وَ یُقِیۡمُوۡنَ الصَّلٰوۃَ “ এবং তারা ( মুত্তাকীরা) নামাজ কায়েম করে”-আল বাকারাঃ০৩।
মুত্তাকীদে ২য় বৈশিষ্ট্য হলো তারা শুধু আমি ঈমান এনেছি,আমি ঈমানদার এই কথা বলেই বসে থাকে না বরং তারা ঈমানের বাস্তব প্রতিফলন ঘটায় তাদের দৈনন্দিন কাজ কর্মে। তারা ঈমান আনার পরই তাদের মস্তক অবনত করে দেয় মহান রবের কাছ। ঈমান আনার পরই তারা নামাজ কায়েমের মাধ্যমে তাদেরকে সমর্পন করে দেয় আল্লাহর দরবারে। তারা গতানুগতিক ভাবে নামাজ আদায় করে না বরং খুঁশু-খুঁজুর সাথে, যথা সময়ে, যথাযত ভাবে নামাজ আদায় করে। রাসূল সাঃ যেভাবে নামাজ পড়েছেন,যেভাবে পড়তে বলেছেন সেভাবেই নামাজ আদায় করার চেষ্টা করেন। এমনকি তারা নিজে নামাজ পড়েই সন্তুষ্ট হন না ,তারা নিজের পরিবার,সমাজ ও রাষ্ট্রেও নামাজ কায়েম করতে চায় ,প্রতিষ্ঠিত করতে চায় এবং এ জন্য নিরলস ভাবে কাজ করে যায়।
৩) সমূহ সম্পদ আল্লাহর পথে ব্যয় করেঃ–
কোরআনে ঘোষণা হয়েছে- اِنَّ اللّٰهَ اشۡتَرٰی مِنَ الۡمُؤۡمِنِیۡنَ اَنۡفُسَهُمۡ وَ اَمۡوَالَهُمۡ بِاَنَّ لَهُمُ الۡجَنَّۃَ “ নিঃসন্দেহে আল্লাহ ঈমানদারদের কাছ থেকে তাদের ধন-সম্পদসমূকে জান্নাতের বিনিময়ে খরিদ করে নিয়েছেন”- আত তাওবাঃ১১১।
মুত্তাকীরা আল্লাহ প্রদত্ত জ্ঞান,বুদ্ধি,দক্ষতা,প্রতিভা,গুণ,যোগ্যতা, উৎপাদনশীলতা, পারদর্শিতা, মেধা, প্রজ্ঞা, সৃজনশীলতা, শারীরিক শক্তি, সামর্থ্য, ধন, সম্পদ, ক্ষমতা সর্বসাকূল্যে তাদের সব আল্লাহর পথেই ব্যয় করে। তারা তাদের সব কিছুকেই তাদে মনে করে না ,তারা মনে করে এসবই আল্লাহ তাদের কাছে আমানত রেখেছেন। কেননা, আল্লাহ সকল মোমিনের জান মাল জান্নাতের বিনমিয়ে ক্রয় করে নিয়েছেন।
এজন্য মুত্তাকীরা আল্লাহর দেয়া রিজিক আল্লাহর পথেই ব্যয় করে। আল্লাহ বলেন- وَ مِمَّا رَزَقۡنٰهُمۡ یُنۡفِقُوۡنَ “আমি তাদের যে রিজিক্ব দান করেছি তা হতে ( আমার পথেই) ব্যয় কর”-আল বাকারাঃ০৩।
৪) সকল আসমানী কিতাবে বিশ্বাস করেঃ-
وَ الَّذِیۡنَ یُؤۡمِنُوۡنَ بِمَاۤ اُنۡزِلَ اِلَیۡکَ وَ مَاۤ اُنۡزِلَ مِنۡ قَبۡلِکَ “আর যারা ঈমান আনে তাতে, যা আপনার উপর নাযিল করা হয়েছে (আল কোরআন) এবং যা আপনার পূর্বে নাযিল করা হয়েছে ( পূর্ববর্তী সকল আসমানী কিতাব)”-আল বাকারাঃ০৪।
মুত্তাকীরা কেবল আল কোরআনকেই সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ আসমানী কিতাব মনে করেই বসে থাকেনা বরং সকল অসমানী কিতাবেও বিশ্বাস স্থাপন করেন। তারা মনে করেন আল কোরআন সকল মানব জাতরি জন্য একটি পরিপূর্ণ জীবন বিধান এই কোরআনের অনুকরণ ও অনুসরণের মাধ্যমেই একজন মানুষের ইহকালীণ ও পরকালীণ কল্যাণ নিহিত রয়েছে। আর পূর্বের কিতাব সমূহে মানুষের জন্য যে শিক্ষা সমূহ বর্ণনা করা হয়েছিল তার সমস্ত কিছুই কোরআনে সংযোজিত করার মাধ্যমে ঐ সমস্ত কিতাব সমূহ বায়েজাপ্ত করা হয়েছে। বর্তমানে মহা পবিত্র এই কোরআনই সকল মানুষ,সকল দেশ ও জাতির জন্য মুক্তির একমাত্র পাথেয়। এই কোরআনকে মেনে নিয়ে কোরআনের সকল বিষয় জীবনে বাস্তবায়ন করার উপরই সমগ্র মানুষের জীবনের প্রকৃতকল্যাণ নিহিতি রয়েছে।
৫) পরকালে বিশ্বাস স্থাপন করেঃ-
আল্লাহ বলেন- وَ بِالۡاٰخِرَۃِ هُمۡ یُوۡقِنُوۡنَ “আর যারা পরকালে বিশ্বাস করে”- আল বাকারাঃ ০৪।
দুনিয়াটা মস্ত বড়, খাও দাও ফূর্তি কর! এই কথা ভেবে তারা হুজুগে ডুবে যান না।
বরং তারা মনে করেন, এ দুনিয়ায় মানুষ কোন দায়িত্বহীন জীব নয়। বরং নিজের সকল কাজের জন্য তাকে আল্লাহর সামনে জবাব দিহি করত হবে। তারা আরো মনে করে, দুনিয়ার র্বতমান ব্যবস্থা চিরস্থায়ী নয়। কোন একদিন এটি শেষ হয়ে যাবে এবং কখন শেষ হবে তা কেবল আল্লাহই জানেনে। এখানেই শেষ নয়, এ দুনিয়া শেষ হবার পর আরেকটি চিরস্থায়ী দুনিয়া আছে ,সেখানে সৃষ্টির শুরু থেকে কেয়ামত পর্যন্ত সকল মানুষকে পুণরায় জীবিত করা হবে। সবাইকে সেদিন তাদের সকল কর্মকান্ডের হিসেব দিতে হবে। কৃতকর্মের জন্য সেদিন কারো জন্য থাকবে চিরসুখের জান্নাত, কারো জর্য চির অশান্তির জাহান্নাম। বর্তমান জীবনের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও অসমৃদ্ধি ,সাফল্য ব্যর্থতার আসল মানদন্ড নয়। বরং শেষ বিচারের দিন যে বেঁচে যাবে সেই প্রকৃত সফলকাম। এজন্য একজন মুত্তাকী দুনিয়াকে প্রাধান্য না দিয়ে পরকাল মুখী জীবন গঠনে সদাসর্বদা প্রচেষ্টা চালায়।
আমদেরকেও দুনিয়াবী কল্যাণ ও পরকালীণ মুক্তি লাভের জন্য, এই গুণগুলো অর্জন করে ,মুত্তাকী হয়ে জীবন যাপন করতে হবে। তবেই শেষ বিচারের দিনে প্রকৃত সফলতা অর্জন করতে পারবো, ইন শা আল্লাহ!