সংকলনে- আবদুর রহমান
হাদিস ইসলামী জীবনধারার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যা আমাদেরকে নবী মুহাম্মদ (সা.) এর শিক্ষা ও দিকনির্দেশনা প্রদান করে। এটি কুরআনের পরে ইসলামের দ্বিতীয় প্রধান উৎস হিসেবে বিবেচিত হয়। হাদিসের মাধ্যমে আমরা নবীজির জীবন, আচরণ ও বাণী সম্পর্কে জানতে পারি, যা আমাদের দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনুসরণীয়। হাদিস আমাদের নৈতিকতা, আচার-আচরণ এবং সামাজিক সম্পর্কের উন্নতি সাধনে সহায়ক হয়। এটি মুসলিমদের জন্য ধর্মীয় আচার-বিধি এবং সামাজিক শিষ্টাচার নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অতএব, হাদিসের গুরুত্ব মানব জীবনে অপরিসীম ও অপরিহার্য।
নিচে কিছু জনপ্রিয় হাদিস সংকলিত করা হলো, যেগুলি মুসলিম উম্মাহর মধ্যে বিশেষ জনপ্রিয়:
- ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভ:
- হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, “ইসলাম পাঁচটি স্তম্ভের উপর প্রতিষ্ঠিত: আল্লাহর একত্বের স্বাক্ষ্য দেওয়া, নামাজ কায়েম করা, যাকাত প্রদান করা, রোজা রাখা এবং হজ্জ করা।” (বুখারী ও মুসলিম)
- আখলাক (শিষ্টাচার):
- রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, “তোমাদের মধ্যে সে-ই উত্তম যে তার আখলাক ভাল।” (বুখারী)
- দয়া ও ক্ষমাশীলতা:
- হযরত আবু হুরায়রা (রা) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, “দয়া করো, তাহলে তোমার উপর দয়া করা হবে; ক্ষমা করো, তাহলে তোমাকে ক্ষমা করা হবে।” (তিরমিজি)
- সদকাহ (দান):
- রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, “সদকাহ কখনো সম্পদের পরিমাণ কমায় না।” (মুসলিম)
- শান্তি ও নিরাপত্তা:
- হযরত আবু হুরায়রা (রা) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, “যে ব্যক্তি তার প্রতিবেশীর ক্ষতি থেকে নিরাপদ, সে-ই প্রকৃত মুসলিম।” (বুখারী)
- তওবা (পশ্চাতাপ):
- রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, “তওবা করা পাপের কাফফারা (প্রায়শ্চিত্ত)।” (মুসলিম)
- ধৈর্য ও সহনশীলতা:
- হযরত আবু সাঈদ খুদরি (রা) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, “কষ্টে ও বিপদে ধৈর্যধারণকারী ব্যক্তি প্রকৃত মুমিন।” (বুখারী)
- মিথ্যা ও প্রতারণা:
- হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, “মিথ্যা বলা ও প্রতারণা করার মাধ্যমে ঈমান চলে যায়।” (মুসলিম)
- পরিবার ও আত্মীয়তার সম্পর্ক:
- রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, “যে ব্যক্তি তার আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখে, আল্লাহ তার রিজিক বৃদ্ধি করেন।” (বুখারী)
- নারীদের প্রতি সম্মান:
- রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, “নারীদের সাথে উত্তম আচরণ করো।” (মুসলিম)
- আল্লাহর ওপর ভরসা:
- হযরত ইবনে আব্বাস (রা) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, “যে ব্যক্তি আল্লাহর ওপর ভরসা করে, আল্লাহ তার জন্য যথেষ্ট।” (তিরমিজি)
- আল্লাহর স্মরণ:
- হযরত আবু হুরায়রা (রা) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, “আল্লাহর স্মরণকারী হৃদয় কখনো কঠিন হয় না।” (তিরমিজি)
- শুকরিয়া (কৃতজ্ঞতা):
- হযরত আবু হুরায়রা (রা) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, “যে ব্যক্তি মানুষের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে না, সে আল্লাহর প্রতিও কৃতজ্ঞ হয় না।” (তিরমিজি)
- আল্লাহর ভালোবাসা:
- হযরত আবু হুরায়রা (রা) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, “আল্লাহ বলেন, ‘আমি আমার বান্দার সঙ্গে আছি, যখন সে আমাকে স্মরণ করে এবং তার হৃদয় আমার প্রতি অনুরক্ত হয়।'” (বুখারী)
- ইলম (জ্ঞান):
- হযরত আবু দারদা (রা) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, “যে ব্যক্তি ইলম অর্জন করতে বের হয়, আল্লাহ তার জন্য জান্নাতের পথ সহজ করে দেন।” (মুসলিম)
- ধনী ও দরিদ্র:
- হযরত আবু হুরায়রা (রা) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, “আল্লাহ সেই ধনীকে পছন্দ করেন, যে বিনয়ী ও দরিদ্রদের সহায়ক।” (তিরমিজি)
- অহংকার:
- হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, “আল্লাহর সামনে সেই ব্যক্তি প্রিয় নয়, যে অহংকারী।” (মুসলিম)
- সন্তানের অধিকার:
- হযরত আবু হুরায়রা (রা) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, “যে সন্তান তার পিতামাতার প্রতি সদাচার করে, সে জান্নাতের অধিকারী।” (তিরমিজি)
- সন্তোষ:
- হযরত আবু হুরায়রা (রা) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, “আল্লাহর দেয়া রিজিকে সন্তুষ্ট থাকো, তাহলে তোমার হৃদয় সুখী হবে।” (তিরমিজি)
- অহংকারের বিরুদ্ধে সতর্কতা:
- হযরত আবু হুরায়রা (রা) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, “যে ব্যক্তি বিন্দুমাত্র অহংকার নিয়ে জান্নাতে প্রবেশ করতে চায়, সে প্রবেশ করতে পারবে না।” (মুসলিম)
- সৎ কাজের নির্দেশ:
- হযরত আবু হুরায়রা (রা) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, “তোমরা সৎ কাজের নির্দেশ দাও এবং অসৎ কাজ থেকে বিরত রাখো।” (বুখারী)
- আল্লাহর নৈকট্য:
- রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, “আল্লাহ বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আমার প্রতি এক হাত এগিয়ে আসে, আমি তার প্রতি এক হাত এগিয়ে যাই; যে ব্যক্তি আমার দিকে এক হাত হাঁটে, আমি তার দিকে দৌড়ে যাই।'” (বুখারী)
- অপরকে ক্ষমা করা:
- রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, “যে ব্যক্তি অপরকে ক্ষমা করে, আল্লাহ তাকে ক্ষমা করেন।” (মুসলিম)
- ভালো কাজের পুরস্কার:
- রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, “যে ব্যক্তি একটি ভালো কাজ করে, আল্লাহ তাকে দশগুণ পুরস্কার দেন।” (তিরমিজি)
- মুসলিম ভাইয়ের অধিকার:
- হযরত আবু হুরায়রা (রা) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, “এক মুসলিম অন্য মুসলিমের ভাই। সে তার ওপর জুলুম করে না এবং তাকে বিপদে ফেলে না।” (বুখারী)
- সবর ও ধৈর্য:
- রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, “সবর ও ধৈর্য হলো ঈমানের অর্ধেক।” (তিরমিজি)
- মুসলিমের নিরাপত্তা:
- হযরত আবু হুরায়রা (রা) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, “যে ব্যক্তি অন্য মুসলিমের গোপন কথা ফাঁস করে না, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।” (মুসলিম)
- আল্লাহর প্রতি ভালবাসা:
- রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, “আল্লাহ সেই ব্যক্তিকে ভালবাসেন, যে তার বান্দার প্রতি দয়ালু।” (তিরমিজি)
- ইমান ও শিষ্টাচার:
- হযরত আবু হুরায়রা (রা) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, “ইমান হলো ভাল আচরণ এবং সৎকর্ম।” (বুখারী)
- দুনিয়া ও আখিরাতের মধ্যে পার্থক্য:
- রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, “দুনিয়া হলো মুমিনের কারাগার এবং কাফিরের জান্নাত।” (মুসলিম)
- সৎ কাজের পুরস্কার:
- রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, “যে ব্যক্তি একটি ভালো কাজ করে, আল্লাহ তাকে দশগুণ পুরস্কার দেন।” (তিরমিজি)
- ভ্রাতৃত্ব:
- হযরত আনাস (রা) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, “তোমাদের কেউ ততক্ষণ পর্যন্ত মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না সে তার ভাইয়ের জন্য সেই ভালোবাসা পোষণ করে, যা সে নিজের জন্য পোষণ করে।” (বুখারী ও মুসলিম)
- ধনী ও দরিদ্র:
- রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, “দরিদ্র ও অভাবগ্রস্তদের প্রতি দয়া প্রদর্শন করো।” (তিরমিজি)
- কৃপণতা:
- হযরত আবু হুরায়রা (রা) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, “কৃপণতা হলো ধ্বংসের মূল।” (তিরমিজি)
- সুস্থতা ও রোগ:
- হযরত আবু হুরায়রা (রা) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, “আল্লাহ যখন তার বান্দার জন্য কল্যাণ চান, তখন তাকে রোগ দ্বারা পরীক্ষা করেন।” (বুখারী)
- দুঃখ ও আনন্দ:
- রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, “যে ব্যক্তি দুঃখে ধৈর্যধারণ করে, সে জান্নাতের অধিকারী।” (মুসলিম)
- জ্ঞান অর্জন:
- রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, “জ্ঞান অর্জন প্রত্যেক মুসলিম নর ও নারীর ওপর ফরজ।” (ইবনে মাজাহ)
- দুয়া ও ইবাদত:
- রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, “দুয়া হলো ইবাদতের মস্তক।” (তিরমিজি)
- বিরক্তি ও বিরক্তি দূর করা:
- রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, “তোমাদের কেউ যদি অন্যকে বিরক্ত করে, আল্লাহ তাকে জান্নাতে প্রবেশ করতে দেবেন না।” (মুসলিম)
- আল্লাহর সাহায্য:
- হযরত আবু হুরায়রা (রা) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, “আল্লাহ তার বান্দার সাহায্য করেন, যখন বান্দা অন্যের সাহায্য করে।” (তিরমিজি)
- কৃতজ্ঞতা ও শোকর:
- রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, “যে ব্যক্তি আল্লাহর নিয়ামতের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে, আল্লাহ তাকে আরও নিয়ামত দান করেন।” (তিরমিজি)
- প্রতিশ্রুতি ও আমানত:
- রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, “মুনাফিকের তিনটি লক্ষণ: মিথ্যা বলা, প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করা, আমানতের খেয়ানত করা।” (বুখারী ও মুসলিম)
- ইবাদত ও নেক আমল:
- রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, “আল্লাহ সেই ব্যক্তিকে পছন্দ করেন, যে বেশি ইবাদত করে এবং নেক আমল করে।” (তিরমিজি)
- আল্লাহর ভালোবাসা ও ভয়:
- রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, “যে ব্যক্তি আল্লাহর ভালোবাসা ও ভয়কে একত্রে রাখে, আল্লাহ তাকে জান্নাত দান করবেন।” (তিরমিজি)
- পাপ ও তওবা:
- রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, “যে ব্যক্তি পাপ করে এবং পরে তওবা করে, আল্লাহ তাকে ক্ষমা করবেন।” (তিরমিজি)
- সদাচার ও সৌজন্য:
- রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, “সদাচার ও সৌজন্য হলো ঈমানের পরিচয়।” (বুখারী)
- আল্লাহর রহমত:
- রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, “আল্লাহর রহমত হলো তার বান্দাদের জন্য আশ্রয়।” (তিরমিজি)
- কষ্ট ও পরিশ্রম:
- রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, “আল্লাহ তার বান্দাদের কষ্ট ও পরিশ্রমে পুরস্কৃত করেন।” (মুসলিম)
- শান্তি ও নিরাপত্তা:
- রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, “যে ব্যক্তি তার প্রতিবেশীর ক্ষতি থেকে নিরাপদ, সে-ই প্রকৃত মুসলিম।” (বুখারী)
- আল্লাহর পথে দান:
- রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, “আল্লাহর পথে দান করা কখনো সম্পদের পরিমাণ কমায় না।” (মুসলিম)
এই হাদিসগুলি মুসলিম উম্মাহর জীবনের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা দেয়। আশা করি এগুলি আপনার জন্য উপকারী হবে।
হাদিস মানব জীবনের গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা প্রদান করে, যা মুসলমানদের দৈনন্দিন জীবনের আচার-আচরণ, নৈতিকতা ও ধর্মীয় অনুশীলনকে পরিচালিত করে। এটি কুরআনের পর ইসলামের দ্বিতীয় প্রধান উৎস হিসেবে বিবেচিত।