আবদুর রহমান / Popular Blog BD
”সূরা ফিল কুরআনের একটি গুরুত্বপূর্ণ সূরা, যা আল্লাহর সর্বশক্তিমত্তা ও তাঁর প্রিয় বান্দাদের রক্ষার প্রমাণ দেয়। এটি আবরাহার বিশাল হাতির বাহিনীকে ধ্বংস করার ঐতিহাসিক ঘটনা বর্ণনা করে, যা আমাদেরকে আল্লাহর প্রতি অটল বিশ্বাস ও ভরসা রাখার শিক্ষা দেয়। এই সূরা মুসলিমদের জন্য ঈমান মজবুত করার পাশাপাশি অহংকার ও অন্যায়ের পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করে। এটি প্রমাণ করে যে আল্লাহর পরিকল্পনা সর্বদাই সর্বোত্তম এবং তিনি যখন চান, তখন যেকোনো ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করতে পারেন। সূরা ফিল একটি দৃষ্টান্তস্বরূপ ঘটনা, যা আল্লাহর কুদরত ও ক্ষমতার স্মরণ করিয়ে দেয়”
সূরা আল-ফীল
আরবি:
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ
أَلَمْ تَرَ كَيْفَ فَعَلَ رَبُّكَ بِأَصْحَابِ الْفِيلِ
أَلَمْ يَجْعَلْ كَيْدَهُمْ فِي تَضْلِيلٍ
وَأَرْسَلَ عَلَيْهِمْ طَيْرًا أَبَابِيلَ
تَرْمِيهِمْ بِحِجَارَةٍ مِّن سِجِّيلٍ
فَجَعَلَهُمْ كَعَصْفٍ مَّأْكُولٍ
বাংলা উচ্চারণ:
বিস্মিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আলাম তারা কাইফা ফা‘আলা রাব্বুকা বি‘আসহাবিল ফিল
আলাম ইয়াজ‘আল কাইদাহুম ফি তাদলীল
ওয়া আরসালা ‘আলাইহিম তইরান আবাবিল
তারমিহিম বিহিজারাতিম্ মিং সিজ্জীল
ফাজা‘আলাহুম কা‘আছফিম্ মাআকুল
অর্থ:
মহান দয়ালু ও করুণাময়ের নামে (শুরু করছি)
তুমি কি দেখনি কিভাবে তোমার প্রভু হস্তীবাহিনীর সাথে আচরণ করেছেন?
তাদের ষড়যন্ত্র কি তিনি ব্যর্থ করে দেননি?
তিনি তাদের ওপর ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি প্রেরণ করেছেন
যারা তাদের উপর পাথরের কংকর নিক্ষেপ করেছে
তাদেরকে তিনি ভক্ষিত তৃণসদৃশ করে দিয়েছেন
সূরা ফিলে আল্লাহ্ তায়ালা কুরাইশের উপর আব্রাহার আক্রমণের ঘটনা বর্ণনা করেছেন এবং কিভাবে আল্লাহ্ তাদের ধ্বংস করেছিলেন তা তুলে ধরেছেন।
সূরা আল-ফীল নাযিলের প্রেক্ষাপট
সূরা ফিলের নাযিলের প্রেক্ষাপট হিসেবে উল্লেখ করা যায় কাবা শরীফের উপর আবরাহা আল-আশরামের আক্রমণের ঘটনাকে। আবরাহা ছিল ইয়েমেনের একজন রাজা এবং সে কাবা শরীফকে ধ্বংস করতে চেয়েছিল। কাবা ছিল তৎকালীন আরবদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। আবরাহা তার সেনাবাহিনী এবং যুদ্ধহাতি নিয়ে মক্কার দিকে অগ্রসর হয়। এই ঘটনা ঘটে নবী মুহাম্মাদ (সা.)-এর জন্মের প্রায় ৫৫ দিন আগে, যা “আমুল ফিল” বা “হাতির বছর” নামে পরিচিত।
ঘটনা বর্ণনা:
১. আবরাহার পরিকল্পনা: আবরাহা চেয়েছিল তার নির্মিত বিশাল গির্জা ‘আল-কুল্লাইস’ তীর্থযাত্রীদের কাছে জনপ্রিয় করতে। সে চেয়েছিল যে আরবরা তাদের ধর্মীয় কেন্দ্র কাবা ত্যাগ করে তার গির্জায় যাবে।
- মক্কা অভিমুখে যাত্রা: তার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য, আবরাহা বিশাল একটি সেনাবাহিনী এবং হাতির বাহিনী নিয়ে মক্কার দিকে রওনা হয়।
- আল্লাহর হস্তক্ষেপ: মক্কার লোকজন তখন আল্লাহর উপর ভরসা রেখে আবরাহার বাহিনীর মোকাবিলার জন্য প্রস্তুতি নেয়। আল্লাহ তায়ালা আবরাহার বাহিনীকে ধ্বংস করতে ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি প্রেরণ করেন, যাদের প্রতিটি পাখি পাথরের কংকর নিয়ে আক্রমণ করে। এই কংকরগুলো আবরাহার সেনাবাহিনীর উপর পতিত হলে তারা ধ্বংস হয়ে যায়।
- ধ্বংসের বিবরণ: পাখির আক্রমণে আবরাহার সৈন্য ও হাতিরা এমনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল যে তারা খাওয়া তৃণের মতো হয়ে যায়।
সূরা ফিল (আল-ফীল) এর তাফসির
সূরা ফিল মক্কায় নাযিল হয়েছে এবং এর আয়াত সংখ্যা ৫। এই সূরাটি নবী মুহাম্মাদ (সা.)-এর জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার দিকে ইঙ্গিত করে, যা “আমুল ফিল” বা “হাতির বছর” নামে পরিচিত। এই সূরাটি আল্লাহ তায়ালার মহান ক্ষমতা ও তাঁর ঘর কাবা শরীফের রক্ষার একটি চমকপ্রদ দৃষ্টান্ত।
তাফসির:
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ
অর্থ: মহান দয়ালু ও করুণাময়ের নামে (শুরু করছি)।
এই বাক্যটি প্রতিটি সূরার শুরুতে থাকে এবং আল্লাহ তায়ালার নাম নিয়ে সূরা শুরু করা হয়।
أَلَمْ تَرَ كَيْفَ فَعَلَ رَبُّكَ بِأَصْحَابِ الْفِيلِ
অর্থ: তুমি কি দেখনি কিভাবে তোমার প্রভু হস্তীবাহিনীর সাথে আচরণ করেছেন?
এই আয়াতে আল্লাহ তায়ালা নবী মুহাম্মাদ (সা.)-কে এবং সমগ্র মুসলিম উম্মাহকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন কিভাবে তিনি হাতির বাহিনীকে ধ্বংস করেছেন। এটা ছিল এক স্মরণীয় ঘটনা যা মক্কার অধিবাসীরা প্রত্যক্ষ করেছিল।
أَلَمْ يَجْعَلْ كَيْدَهُمْ فِي تَضْلِيلٍ
অর্থ: তাদের ষড়যন্ত্র কি তিনি ব্যর্থ করে দেননি?
আল্লাহ তাদের পরিকল্পনাকে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ করে দিয়েছিলেন। তারা চেয়েছিল কাবা শরীফকে ধ্বংস করতে, কিন্তু আল্লাহ তাদের পরিকল্পনা নস্যাৎ করে দিয়েছিলেন।
وَأَرْسَلَ عَلَيْهِمْ طَيْرًا أَبَابِيلَ
অর্থ: তিনি তাদের ওপর ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি প্রেরণ করেছেন।
আল্লাহ ছোট ছোট পাখির দল পাঠিয়েছিলেন, যারা বিশেষ ধরনের পাথর বহন করেছিল।
تَرْمِيهِمْ بِحِجَارَةٍ مِّن سِجِّيلٍ
অর্থ: যারা তাদের উপর পাথরের কংকর নিক্ষেপ করেছে।
এই পাখিরা আবরাহার সেনাবাহিনীর ওপর পাথরের কংকর নিক্ষেপ করেছিল, যা তাদের ধ্বংস করেছিল।
فَجَعَلَهُمْ كَعَصْفٍ مَّأْكُولٍ
অর্থ: তাদেরকে তিনি ভক্ষিত তৃণসদৃশ করে দিয়েছেন।
আবরাহার সেনাবাহিনী এমনভাবে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল যে তারা খাওয়া তৃণের মতো হয়ে গিয়েছিল। এখানে কুরআন একটি দৃষ্টান্ত ব্যবহার করেছে যা এই ধ্বংসের ভয়াবহতা বুঝিয়ে দেয়।
সূরা ফিল একটি স্মরণীয় ঘটনার দিকে ইঙ্গিত করে যেখানে আল্লাহ তাঁর ঘর কাবা শরীফের রক্ষা করেছিলেন। এই সূরাটি আমাদের শেখায় যে আল্লাহ তায়ালার ক্ষমতা ও কুদরত অপরিসীম এবং তিনি তাঁর প্রিয় বান্দাদের ও ধর্মীয় স্থানসমূহের রক্ষা করেন। এটি একটি প্রেরণামূলক ঘটনা যা মুসলমানদের ঈমানকে মজবুত করে এবং আল্লাহর প্রতি তাদের বিশ্বাস ও নির্ভরতা বৃদ্ধি করে।
সূরা ফিল (আল-ফীল) এর শিক্ষা
সূরা ফিল থেকে আমরা বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা গ্রহণ করতে পারি যা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে প্রভাব ফেলে এবং আমাদের ঈমানকে মজবুত করে।
১. আল্লাহর সর্বশক্তিমত্তা:
সূরা ফিলের মূল শিক্ষা হলো আল্লাহ তায়ালার সর্বশক্তিমান হওয়ার প্রমাণ। তিনি যখন চান, তখন যেকোনো শক্তিশালী বাহিনীকে ধ্বংস করতে পারেন। আবরাহার বিশাল সেনাবাহিনী ও হাতির বাহিনী আল্লাহর হুকুমে পাখির কংকরের আঘাতে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হয়ে যায়।
২. আল্লাহর সাহায্য ও রক্ষা:
এই সূরাটি আমাদের শেখায় যে আল্লাহ তাঁর প্রিয় বান্দাদের এবং তাঁর পবিত্র স্থানসমূহের রক্ষা করেন। কাবা শরীফকে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্র সফল হয়নি কারণ আল্লাহ নিজেই এর রক্ষা করেছেন।
৩. বিশ্বাস ও ভরসা:
মুসলিমদের উচিত সবসময় আল্লাহর উপর পূর্ণ বিশ্বাস ও ভরসা রাখা। তিনি সবসময় আমাদের রক্ষা করবেন এবং আমাদের সাহায্য করবেন যদি আমরা তাঁর প্রতি সত্যিকারের বিশ্বাস রাখি।
৪. অহংকার ও অন্যায়ের পরিণাম:
আবরাহা কাবা ধ্বংস করার মত অহংকারী ও অন্যায় কাজের পরিকল্পনা করেছিলেন। তার এই অহংকার ও অন্যায়ের পরিণতি ছিল ধ্বংস। এই ঘটনা আমাদের শেখায় যে অহংকার ও অন্যায়ের পরিণতি সবসময় খারাপ হয়।
৫. আল্লাহর পরীক্ষা:
সূরা ফিল আমাদের শেখায় যে আল্লাহ আমাদেরকে বিভিন্নভাবে পরীক্ষা করেন এবং আমাদের বিশ্বাস ও ধৈর্য পরীক্ষা করেন। কঠিন পরিস্থিতিতে আমাদের ধৈর্য ও বিশ্বাস হারানো উচিত নয়।
৬. ঐতিহাসিক ঘটনার স্মৃতি:
এই সূরাটি একটি ঐতিহাসিক ঘটনার স্মৃতি ধারণ করে যা আমাদের বিশ্বাসকে মজবুত করে এবং আল্লাহর কুদরতের প্রমাণ দেয়।
৭. আল্লাহর পরিকল্পনা সর্বোত্তম:
মানুষ অনেক সময় নিজের পরিকল্পনা নিয়ে অহংকার করে, কিন্তু আল্লাহর পরিকল্পনা সর্বোত্তম। তিনি যখন চান, তখন মানুষের পরিকল্পনা ব্যর্থ করে দিতে পারেন।
৮. আল্লাহর সাহায্য পেতে পবিত্রতার গুরুত্ব:
মক্কা ও কাবা শরীফের পবিত্রতার জন্য আল্লাহ এই মহান ঘটনাটি ঘটিয়েছেন। এটি প্রমাণ করে যে পবিত্রতা ও আল্লাহর ঘরকে সম্মান করা কতটা গুরুত্বপূর্ণ।
এই শিক্ষাগুলো আমাদের জীবনে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস ও ভরসা বাড়াতে সাহায্য করে এবং আমাদেরকে সবসময় ন্যায় ও পবিত্রতার পথে চলার প্রেরণা যোগায়।