সূরা ইখলাস: আল্লাহর একত্ব ও অতুলনীয়তার প্রতীক

আবদুর রহমান / Popular Blog BD

সূরা ইখলাস (আল-কুরআন ১১২) ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ একটি সূরা। এই সূরাটি মক্কায় অবতীর্ণ হয়েছে এবং এতে মোট চারটি আয়াত রয়েছে। সূরাটির নাম “ইখলাস” অর্থাৎ “বিশুদ্ধ বিশ্বাস” থেকে এসেছে। সূরা ইখলাস তাওহীদের মূলনীতির উপর ভিত্তি করে রচিত, যা আল্লাহ্‌র একত্ব ও অদ্বিতীয়তা প্রতিষ্ঠিত করে।

সূরা ইখলাস (আল-কুরআন ১১২: ১-৪)

আরবী:

( قُلْ هُوَ ٱللَّهُ أَحَدٌ ﴿١﴾ ٱللَّهُ ٱلصَّمَدُ ﴿٢﴾ لَمْ يَلِدْ وَلَمْ يُولَدْ ﴿٣﴾ وَلَمْ يَكُن لَّهُۥ كُفُوًا أَحَدٌۢ ﴿٤

বাংলা উচ্চারণ:

  1. কুল হুওয়াল্লাহু আহাদ।
  2. আল্লাহুস্-সামাদ।
  3. লাম ইয়ালিদ ওয়ালাম ইয়ূলাদ।
  4. ওয়ালাম ইয়াকুল্লাহূ কুফুওয়ান আহাদ।

বাংলা অর্থ:

  1. বল, তিনিই আল্লাহ, এক (অদ্বিতীয়)।
  2. আল্লাহ, যিনি সবকিছুর নির্ভরস্থল।
  3. তিনি কাউকে জন্ম দেননি এবং তিনিও জন্মগ্রহণ করেননি।
  4. এবং তাঁর সমতুল্য কেউ নেই।

সূরা ইখলাসের নাযিলের প্রেক্ষাপটChatGPT

সূরা ইখলাসের নাযিলের প্রেক্ষাপট

সূরা ইখলাস মক্কায় নাযিল হয়েছিল, যখন ইসলামের প্রাথমিক যুগে মক্কার মুশরিকরা (অবিশ্বাসীরা) আল্লাহ্‌ সম্পর্কে বিভিন্ন ধরনের প্রশ্ন করত এবং নিজেদের বহু ঈশ্বরবাদী ধারণার সাথে ইসলামের একত্ববাদের (তাওহীদ) মূলনীতির বিরোধিতা করত। এই সূরার নাযিলের প্রেক্ষাপট সম্পর্কে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য:

প্রেক্ষাপট:

  1. বিতর্ক ও প্রশ্ন: মক্কার মুশরিকরা প্রায়ই মহানবী মুহাম্মদ (সা.)-কে আল্লাহ্‌র পরিচয় সম্পর্কে প্রশ্ন করত। তারা জানতে চাইত, আল্লাহ্‌ কে? তিনি কেমন? তার পিতামাতা আছে কি? তিনি জন্মগ্রহণ করেছেন কি না? তাদের এই সব প্রশ্নের মূল উদ্দেশ্য ছিল ইসলামের তাওহীদ (একত্ববাদের) মূলনীতিকে খণ্ডন করা।
  2. বহু ঈশ্বরবাদী সংস্কৃতি: মক্কার আরবরা তখন বহু ঈশ্বরবাদে বিশ্বাসী ছিল। তাদের বিশ্বাস ছিল অনেক দেব-দেবী এবং প্রতিমার উপর নির্ভরশীল। তারা মনে করত প্রতিটি দেবতার আলাদা আলাদা ক্ষমতা এবং ভূমিকা রয়েছে। এর বিপরীতে, ইসলাম এক আল্লাহ্‌র উপাসনা প্রচার করত, যিনি অদ্বিতীয়, সবকিছুর সৃষ্টিকর্তা এবং সকল ক্ষমতার উৎস।
  3. তাওহীদের প্রয়োজনীয়তা: এই প্রেক্ষাপটে সূরা ইখলাস নাযিল হয়, যা স্পষ্টভাবে আল্লাহ্‌র একত্ব ও অদ্বিতীয়তা ঘোষণা করে। এটি মুসলমানদের বিশ্বাসের মূলনীতি হিসেবে আল্লাহ্‌র একত্ব এবং তাঁর সাথে কোনো কিছু তুলনা করা যাবে না, এই বিষয়ে নিশ্চিত করে।

নাযিলের লক্ষ্য:

  • সঠিক পরিচয় প্রদান: সূরা ইখলাসের মাধ্যমে আল্লাহ্‌ তাআলা নিজ সম্পর্কে সঠিক পরিচয় প্রদান করেন। তিনি জানান যে, তিনি এক এবং অদ্বিতীয়, এবং তিনি কাউকে জন্ম দেননি, নিজেও জন্মগ্রহণ করেননি।
  • বিশ্বাসের দৃঢ়তা: মুসলমানদের বিশ্বাসের ভিত্তিকে দৃঢ় করার জন্য এই সূরা নাযিল হয়েছিল। এটি মুসলমানদের তাওহীদ (একত্ববাদ) সম্পর্কে একটি সুস্পষ্ট ধারণা দেয় এবং তাদের ঈমান (বিশ্বাস) মজবুত করে।
  • মুশরিকদের উত্তর: মক্কার মুশরিকদের প্রশ্নের একটি চূড়ান্ত এবং পরিষ্কার জবাব প্রদান করাই ছিল এই সূরার অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য।

সূরা ইখলাস ইসলামের তাওহীদের মূলনীতিকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য নাযিল হয়েছিল। এটি আল্লাহ্‌র একত্ব ও অদ্বিতীয়তা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা দেয় এবং মুশরিকদের বহু ঈশ্বরবাদী ধারণার বিরুদ্ধে মুসলমানদের বিশ্বাসকে দৃঢ় করে। এই সূরার প্রতিটি আয়াত আল্লাহ্‌র একত্ব, স্বয়ংসম্পূর্ণতা এবং অতুলনীয়তাকে প্রতিফলিত করে, যা ইসলামের মূল শিক্ষার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।

মূল বিষয়বস্তু:

  • আল্লাহ্‌র একত্ব: সূরাটি আল্লাহ্‌র একত্ব ঘোষণা করে, যেখানে বলা হয়েছে, “তিনি এক এবং অদ্বিতীয়।”
  • অবশ্যপূরণীয় আল্লাহ্‌: এখানে আল্লাহ্‌কে “সামাদ” বলা হয়েছে, অর্থাৎ তিনি এমন একজন যার উপর সবকিছু নির্ভরশীল এবং তিনি কারো উপর নির্ভরশীল নন।
  • সৃষ্টিহীন এবং অসৃষ্ট: সূরাটি স্পষ্টভাবে বলে যে, আল্লাহ্‌ কাউকে জন্ম দেননি এবং তিনি নিজেও জন্মগ্রহণ করেননি।
  • অতুলনীয়তা: শেষ আয়াতে বলা হয়েছে, আল্লাহ্‌র সমতুল্য কেউ নেই।

গুরুত্ব:

  • বিশ্বাসের অঙ্গীকার: সূরা ইখলাস মুসলমানদের বিশ্বাসের অঙ্গীকারকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করে।
  • ইবাদতের অংশ: প্রতিদিনের নামাযে সূরা ইখলাস পাঠ করা হয় এবং এটি মুসলমানদের দৈনন্দিন জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

বিশেষত্ব:

  • সহজ ও সংক্ষিপ্ত: সূরাটি খুবই সংক্ষিপ্ত, কিন্তু এর মধ্যে গভীর তাত্ত্বিক ও আধ্যাত্মিক বার্তা রয়েছে।
  • অধিক সওয়াব: ইসলামী হাদিস অনুযায়ী, সূরা ইখলাস তিনবার পাঠ করলে তা পুরো কুরআন খতমের সমতুল্য সওয়াবের অধিকারী হয়।

সূরা ইখলাস মুসলমানদের মধ্যে তাওহীদের মূলনীতি প্রতিষ্ঠিত করে এবং আল্লাহ্‌র একত্বের উপর অটল বিশ্বাস রাখার জন্য উদ্বুদ্ধ করে।

সূরা ইখলাসের তাফসির ও শিক্ষনীয় বিষয়গুলো

সূরা ইখলাস ইসলামের মূল তাওহীদের শিক্ষা প্রদান করে এবং এর তাফসির ও শিক্ষনীয় বিষয়গুলো নিম্নরূপ:

তাফসির:

  1. قُلْ هُوَ ٱللَّهُ أَحَدٌ (কুল হুওয়াল্লাহু আহাদ):
    • তাফসির: আল্লাহ্‌ তাআলা আমাদের বলছেন, “বল, তিনিই আল্লাহ্‌, এক এবং অদ্বিতীয়।” এখানে “আহাদ” শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে, যা সম্পূর্ণ এবং একক অদ্বিতীয়তা বোঝায়।
    • শিক্ষা: আল্লাহ্‌র একত্বের মূলনীতি প্রতিষ্ঠিত করা এবং তাঁর সত্তার এককতার উপর বিশ্বাস রাখা।
  2. ٱللَّهُ ٱلصَّمَدُ (আল্লাহুস্-সামাদ):
    • তাফসির: “সামাদ” অর্থ হলো সকল কিছুর নির্ভরযোগ্য। আল্লাহ্‌ তাআলা সমস্ত সৃষ্টির প্রয়োজন পূরণকারী, কিন্তু তিনি কারো উপর নির্ভরশীল নন।
    • শিক্ষা: আল্লাহ্‌র সর্বশক্তিমান ও স্বয়ংসম্পূর্ণতার উপর আস্থা রাখা এবং তাঁর উপর নির্ভর করা।
  3. لَمْ يَلِدْ وَلَمْ يُولَدْ (লাম ইয়ালিদ ওয়ালাম ইয়ূলাদ):
    • তাফসির: আল্লাহ্‌ কাউকে জন্ম দেননি এবং তিনি নিজেও জন্মগ্রহণ করেননি। এই আয়াতটি আল্লাহ্‌র সৃষ্টিহীনতা এবং সৃষ্টিকর্তা হিসাবে তার এককত্বকে বোঝায়।
    • শিক্ষা: আল্লাহ্‌ তাআলার সৃষ্টিহীনতা এবং তাঁর কোনও পিতা-মাতা বা সন্তান নেই, এই বিশ্বাসকে দৃঢ় করা।
  4. وَلَمْ يَكُن لَّهُۥ كُفُوًا أَحَدٌۢ (ওয়ালাম ইয়াকুল্লাহূ কুফুওয়ান আহাদ):
    • তাফসির: তাঁর সমতুল্য কেউ নেই। আল্লাহ্‌র সমকক্ষ বা তুলনীয় কেউ নেই।
    • শিক্ষা: আল্লাহ্‌ তাআলার অতুলনীয়তা এবং অনন্যত্বের উপর বিশ্বাস স্থাপন করা।

শিক্ষনীয় বিষয়গুলো:

  1. তাওহীদের প্রতিষ্ঠা:
    • সূরা ইখলাস তাওহীদের মূলনীতি প্রতিষ্ঠিত করে, যা ইসলামের কেন্দ্রবিন্দু। এটি আল্লাহ্‌র একত্ব এবং অদ্বিতীয়তা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা প্রদান করে।
  2. আল্লাহ্‌র উপর নির্ভরশীলতা:
    • আল্লাহ্‌ তাআলা সকল সৃষ্টির প্রয়োজন পূরণ করেন এবং তিনি কারো উপর নির্ভরশীল নন। এটি আমাদের আল্লাহ্‌র উপর সম্পূর্ণ আস্থা ও নির্ভরশীলতা শেখায়।
  3. আল্লাহ্‌র সৃষ্টিহীনতা:
    • আল্লাহ্‌ কাউকে জন্ম দেননি এবং তিনিও জন্মগ্রহণ করেননি। এটি আল্লাহ্‌র চিরন্তন এবং সৃষ্টিহীন সত্তার প্রতি আমাদের বিশ্বাসকে দৃঢ় করে।
  4. আল্লাহ্‌র অতুলনীয়তা:
    • আল্লাহ্‌ তাআলার তুলনা কেউ হতে পারে না। তিনি একমাত্র এবং অনন্য। এই বিশ্বাস আমাদেরকে অন্যান্য সকল সত্তা থেকে আল্লাহ্‌কে পৃথক করে পূজা করতে শেখায়।
  5. বিশুদ্ধ ঈমান:
    • সূরা ইখলাস আমাদেরকে বিশুদ্ধ ঈমান এবং আন্তরিকতার সাথে আল্লাহ্‌র উপাসনা করতে শেখায়। এটি আমাদের হৃদয় ও আত্মাকে শুদ্ধ করে আল্লাহ্‌র প্রতি সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ করতে উদ্বুদ্ধ করে।

সূরা ইখলাস আমাদেরকে আল্লাহ্‌র একত্ব, স্বয়ংসম্পূর্ণতা, সৃষ্টিহীনতা এবং অতুলনীয়তার উপর বিশ্বাস স্থাপন করতে শেখায়, যা ইসলামের মূল ভিত্তি। এটি আমাদের আধ্যাত্মিক ও ধর্মীয় জীবনে গভীর প্রভাব ফেলে এবং আমাদের ঈমানকে দৃঢ় করে।

Leave a Comment