দাঁতঃ দাঁতের সকল সমস্যার সহজ সমাধান

লিখেছেন- আবদুর রহমান

দাঁত হল কঠিন, সাদা বা হলুদাভ অংশ যা মুখের ভেতর চোয়ালে বা মাড়ির মধ্যে থাকে। দাঁত মূলত দুই ভাগে বিভক্ত: দাঁতের মুকুট (crown) এবং শিকড় (root)।

নিচে দাঁত সম্পর্কে কি বিস্তারিত তথ্য দেওয়া হলো:

দাঁতের গঠন

  1. এনামেল (Enamel):
    1. দাঁতের বাহ্যিক স্তর।
    1. এটি শরীরের সবচেয়ে কঠিন এবং খনিজ পদার্থ।
  2. ডেন্টিন (Dentin):
    1. এনামেলের নিচে থাকে।
    1. এনামেলের মতো কঠিন নয়, তবে হাড়ের চেয়ে বেশি শক্ত।
  3. পাল্প (Pulp):
    1. দাঁতের অভ্যন্তরীণ অংশ।
    1. এতে স্নায়ু ও রক্তনালী থাকে, যা দাঁতকে জীবিত রাখে।
  4. সিমেন্টাম (Cementum):
    1. দাঁতের শিকড়কে ঘিরে থাকে।
    1. মাড়ির সঙ্গে দাঁতকে সংযুক্ত করে রাখে।

দাঁতের প্রকারভেদ

  1. ইনসিসর (Incisor):
    1. সামনের ধারালো দাঁত।
    1. খাবার কাটার জন্য ব্যবহৃত হয়।
  2. ক্যানাইন (Canine):
    1. ধারালো ও পয়েন্টেড দাঁত।
    1. খাবার ছেঁড়ার জন্য ব্যবহৃত হয়।
  3. প্রিমোলার (Premolar):
    1. ক্যানাইন এবং মোলারের মধ্যে থাকে।
    1. খাবার পিষার জন্য ব্যবহৃত হয়।
  4. মোলার (Molar):
    1. পেছনের বড় দাঁত।
    1. খাবার চূর্ণ-বিচূর্ণ করার জন্য ব্যবহৃত হয়।

দাঁত এর গুরুত্বঃ

দাঁতের গুরুত্ব অনেক ব্যাপক। দাঁত শুধু খাবার চিবানো ও খাওয়ার প্রক্রিয়ায় সহায়তা করে না, তা আমাদের মুখের গঠন ও সৌন্দর্যও বজায় রাখে। নিচে দাঁতের গুরুত্ব নিয়ে কয়েকটি প্রধান দিক তুলে ধরা হলো:

  1. খাওয়ার জন্য: দাঁত খাবার চিবিয়ে ছোট ছোট টুকরো করতে সাহায্য করে, যা হজম প্রক্রিয়ার প্রথম ধাপ।
  2. উচ্চারণে সহায়তা: সঠিকভাবে শব্দ উচ্চারণ করতে দাঁত সহায়ক ভূমিকা পালন করে। কিছু ধ্বনি তৈরি করতে দাঁতের সঠিক অবস্থান প্রয়োজন হয়।
  3. মুখের গঠন: দাঁত মুখের গঠন বজায় রাখতে সহায়ক। দাঁত না থাকলে মুখের গঠন পরিবর্তিত হতে পারে।
  4. স্বাস্থ্য সূচক: দাঁতের স্বাস্থ্যের মাধ্যমে শরীরের সামগ্রিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। দাঁতের কোনো সমস্যা প্রায়ই অন্যান্য স্বাস্থ্যের সমস্যার ইঙ্গিত দেয়।
  5. আত্মবিশ্বাস: সুন্দর ও সঠিকভাবে সাজানো দাঁত মুখের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে এবং মানুষের আত্মবিশ্বাস বাড়ায়।
  6. অকালে বার্ধক্য প্রতিরোধ: দাঁতের সঠিক যত্ন না নিলে গাম ও মুখের অন্যান্য সমস্যার কারণে মুখে বার্ধক্যের লক্ষণ দেখা দিতে পারে।

দাঁতের সঠিক যত্ন নিতে নিয়মিত ব্রাশ করা, ফ্লস করা, এবং ডেন্টিস্টের কাছে চেকআপ করা প্রয়োজন। এছাড়া, সঠিক খাদ্যাভ্যাস ও স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন দাঁতের স্বাস্থ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

দাঁতের যত্ন

  1. নিয়মিত ব্রাশিং:
    1. অন্তত দিনে দু’বার দাঁত ব্রাশ করা উচিত।
  2. ফ্লসিং:
    1. দাঁতের ফাঁকে আটকে থাকা খাবার অপসারণের জন্য।
  3. মুখের ধোয়া:
    1. ব্যাকটেরিয়া ও জীবাণু দূর করার জন্য মুখ ধোয়া।
  4. নিয়মিত দাঁতের ডাক্তার দেখা:
    1. ছয় মাস পর পর দাঁতের ডাক্তারকে দেখানো উচিত।

দাঁতের সমস্যাগুলি

  1. ক্যাভিটি (Cavity):
    1. দাঁতে ক্ষয় হওয়া।
    1. সাধারণত দাঁতে গর্ত দেখা দেয়।
  2. জিঞ্জিভাইটিস (Gingivitis):
    1. মাড়ির প্রদাহ।
    1. রক্তপাত এবং ফুলে যাওয়ার কারণ হতে পারে।
  3. পিরিয়ডন্টাইটিস (Periodontitis):
    1. মাড়ি ও হাড়ের গুরুতর সংক্রমণ।
  4. দাঁতের ক্ষয় (Tooth Erosion):
    1. এসিডের কারণে দাঁতের এনামেল ক্ষয়।

দাঁত এর চিকিৎসা

দাঁতের চিকিৎসা বিভিন্ন ধরনের হতে পারে, কারণ বিভিন্ন সমস্যা দাঁতে দেখা যেতে পারে। এখানে দাঁতের বিভিন্ন ধরনের সমস্যার জন্য বিস্তারিত চিকিৎসার আলোচনা করা হলো:

১. দাঁতের ক্ষয় (Cavity)

চিকিৎসা:

  • ফ্লুরাইড ট্রিটমেন্ট: প্রাথমিক অবস্থায় ক্ষয় দূর করতে ফ্লুরাইড জেল বা বার্নিশ ব্যবহার করা হয়।
  • ফিলিং: ক্ষতিগ্রস্ত অংশ সরিয়ে সেই স্থানে ফিলিং ম্যাটেরিয়াল ব্যবহার করা হয়।
  • ক্রাউন: যদি ক্ষয় বেশি হয় তবে দাঁতকে রক্ষা করতে ক্রাউন বা কভারিং লাগানো হয়।
  • রুট ক্যানেল থেরাপি: যদি ক্ষয় গভীর হয় এবং দাঁতের ভেতরের নার্ভ আক্রান্ত হয় তবে রুট ক্যানেল করা হয়।

২. দাঁতের সংক্রমণ (Infection)

চিকিৎসা:

  • এন্টিবায়োটিক: সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে এন্টিবায়োটিক দেওয়া হয়।
  • রুট ক্যানেল থেরাপি: দাঁতের মূল নার্ভের সংক্রমণ হলে রুট ক্যানেল করা হয়।
  • এক্সট্রাকশন: যদি দাঁতটি সংরক্ষণ করা সম্ভব না হয়, তবে তা উপড়ে ফেলা হয়।

৩. মাড়ির রোগ (Gum Disease)

চিকিৎসা:

  • স্কেলিং এবং রুট প্ল্যানিং: মাড়ির নিচে এবং দাঁতের মুলে থাকা প্লাক এবং টার্টার সরানো হয়।
  • এন্টিবায়োটিক: সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে এন্টিবায়োটিক দেওয়া হয়।
  • সার্জারি: প্রয়োজনে মাড়ির সার্জারি করা হয়, যেমন পকেট রিডাকশন সার্জারি বা ফ্ল্যাপ সার্জারি।

৪. দাঁত ভেঙে যাওয়া বা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া (Broken or Damaged Tooth)

চিকিৎসা:

  • ডেন্টাল বন্ডিং: ছোট ফাটল বা ভাঙ্গা অংশ মেরামত করতে বন্ডিং ম্যাটেরিয়াল ব্যবহার করা হয়।
  • ক্রাউন: বড় ফাটল বা ভাঙ্গা হলে দাঁতের উপরে ক্রাউন লাগানো হয়।
  • ভিনিয়ার: সামনের দাঁত ভাঙ্গলে ভিনিয়ার লাগানো হয়।

৫. দাঁতের রং পরিবর্তন (Discoloration)

চিকিৎসা:

  • প্রফেশনাল ক্লিনিং: দাঁতের উপর থেকে স্টেইন সরাতে দাঁত ক্লিন করা হয়।
  • ব্লিচিং: দাঁতের রং পরিবর্তন করতে ব্লিচিং করা হয়।
  • ভিনিয়ার: যদি ব্লিচিং কাজ না করে, তবে ভিনিয়ার লাগানো হয়।

৬. দাঁতের সোজা করা (Orthodontics)

চিকিৎসা:

  • ব্রেস: টিট বা দাঁতের অবস্থান সঠিক করতে ব্রেস ব্যবহার করা হয়।
  • ইনভিজিলাইন: দাঁত সোজা করার জন্য ট্রান্সপারেন্ট অ্যালাইনার ব্যবহার করা হয়।

৭. দাঁতের বদলে নতুন দাঁত (Prosthetics)

চিকিৎসা:

  • ডেন্টাল ইমপ্ল্যান্ট: মিসিং দাঁত পূরণ করতে ইমপ্ল্যান্ট করা হয়।
  • ডেন্টাল ব্রিজ: মিসিং দাঁতের স্থানে ব্রিজ ব্যবহার করা হয়।
  • ডেন্টাল ডেনচার: মিসিং দাঁত পূরণের জন্য ডেনচার ব্যবহার করা হয়।

এছাড়া প্রতিদিন নিয়মিত দাঁত ব্রাশ করা, ফ্লসিং করা, ও ডেন্টিস্টের কাছে নিয়মিত চেকআপ করানো দাঁতের সমস্যাগুলি প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে।

দাঁত এর ঘরোয়া চিকিৎসা

দাঁতের যত্নের জন্য কিছু ঘরোয়া চিকিৎসা নিচে দেওয়া হল:

দাঁতের ব্যথা

  1. লবঙ্গ তেল: লবঙ্গ তেল দাঁতের ব্যথা কমাতে কার্যকর। তুলায় কয়েক ফোঁটা লবঙ্গ তেল নিয়ে ব্যথাযুক্ত দাঁতে লাগান।
  2. লবণ পানি: এক গ্লাস গরম পানিতে এক চামচ লবণ মিশিয়ে কুলকুচি করুন। এটি জীবাণুনাশক হিসেবে কাজ করে এবং ব্যথা কমাতে সহায়তা করে।

দাঁত সাদা করা

  1. বেকিং সোডা লেবুর রস: এক চামচ বেকিং সোডা ও এক চামচ লেবুর রস মিশিয়ে পেস্ট তৈরি করুন এবং দাঁতে লাগান। ১-২ মিনিট পর ধুয়ে ফেলুন।
  2. কোকোনাট অয়েল পুলিং: মুখে এক চামচ কোকোনাট অয়েল নিয়ে ১৫-২০ মিনিট ধরে কুলকুচি করুন। এটি দাঁত সাদা করতে সাহায্য করে।

দাঁতের মাড়ির সমস্যা

  1. নিম পাতা: নিম পাতা ফুটিয়ে সেই পানি দিয়ে কুলকুচি করুন। এটি দাঁতের মাড়ির ইনফেকশন কমাতে সাহায্য করে।
  2. অ্যালোভেরা জেল: মাড়িতে অ্যালোভেরা জেল লাগিয়ে ৫-১০ মিনিট রেখে ধুয়ে ফেলুন। এটি মাড়ির ইনফ্লেমেশন কমায়।

দাঁতের সংক্রমণ

  1. রসুন: রসুনের পেস্ট ব্যথাযুক্ত বা সংক্রমিত দাঁতে লাগান। রসুনে থাকা অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল উপাদান সংক্রমণ কমাতে সাহায্য করে।
  2. পেঁয়াজ: কাঁচা পেঁয়াজের টুকরা চিবান। এটি ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস করে দাঁতের সংক্রমণ কমায়।

নিয়মিত যত্ন

  1. ব্রাশিং: দিনে দুইবার ব্রাশ করুন এবং প্রতিবার ২ মিনিট ধরে ব্রাশ করুন।
  2. ফ্লসিং: প্রতিদিন অন্তত একবার দাঁতের ফাঁকে ফ্লস ব্যবহার করুন।

খাদ্যাভ্যাস

  1. ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার: দুধ, চিজ, দই ইত্যাদি খাবারে ক্যালসিয়াম প্রচুর থাকে যা দাঁতের স্বাস্থ্যের জন্য ভালো।
  2. শর্করা নিয়ন্ত্রণ: অতিরিক্ত চিনি এবং মিষ্টি খাবার খাওয়া কমান।

এই ঘরোয়া চিকিৎসাগুলো দাঁতের স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী হতে পারে, তবে গুরুতর সমস্যা থাকলে অবশ্যই দন্তচিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া দরকার।

Leave a Comment